বাংলাদেশের ব্যান্ড ইতিহাস ( Bangladesh Band History)
“ব্যান্ড” শব্দটি শুনলে প্রথমেই পাশ্চাত্যের সংগীতের যন্ত্রশিল্পী বা গানের দলের কথা আগে মনে আসে, যা বিভিন্ন সময়ে কম্বো, পপ গ্রুপ, রক ব্যান্ড বা জ্যাজ ব্যান্ড নামে পরিচিত। আমাদের দেশে এই বিশেষধারার সংগীত যেহেতু ব্যান্ড দ্বারা উপস্থাপিত হয়, সেহেতু এই ধারাকে মোটা দাগে আমরা “ব্যান্ড সংগীত” বলে থাকি। নির্দিষ্ট কোন “জনরা” বা “ধারা” বিবেচনায় থাকেনা। ব্লুজ, জ্যাজ, আর এন্ড বি, পপ, রক, রেগে প্রভৃতিসহ দেশীয় লোকধারার উপাদান এখানে বর্তমান।
আমাদের দেশে পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাস ইউরোপিয়ানদের আগমনের সাথে লেখা শুরু হয়েছিল। ধর্ম প্রচারের জন্য তারা বিভিন্ন জায়গায় মিশনারী স্থাপন করেন। খ্রিষ্টীয় ধর্মের সাথে সংগীত অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত বিধায় ধর্ম প্রচারে এই সংগীতের ব্যবহার দেশীয়দের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে এইসব মিশনারী স্কুল কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে এবং অন্যান্য ধর্মানুসারীরাও পাঠ নিতে থাকে। সেইসব মিশনারী স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভিতর প্রথম পাশ্চাত্যের সংগীতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। কিছু স্কুলে পাদ্রীরা পাশ্চাত্য যন্ত্র যেমন- পিয়ানো/অর্গান শিক্ষা ও সংগীততত্ত্ব পাঠদান প্রচলন করে। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে দেশীয় গুটিকয়েক সুরস্রষ্টার কাজে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গ্রামোফোন, রেকর্ড যুগের আবির্ভাবে এই প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। বাংলা গানে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি বেহালা, পিয়ানো, ক্ল্যারিনেট স্প্যানিশ গীটার প্রভৃতি সমানভাবে সমাদৃত হতে থাকে।
ঢাকা ছাড়াও সমুদ্রবন্দর হওয়ায় চট্রগ্রামে বিভিন্ন সময়ে নানাদেশের মানুষ আসতেন। তারাও অবসরে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান বাজনা করতেন। এগুলি দেখেও তখনকার অনেক কিশোর যুবক এই সংগীতকে ভালবাসতে শুরু করেন। অনেকসময় এইসব বিদেশীরা এদেশ থেকে চলে যাবার সময় তাদের বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে যেতেন, সেগুলিই সর্বপ্রথম এদেশের মানুষের হাতে আসা শুরু করে। অবশ্য, অনেক ধনী পরিবারের সদস্য তখন বিদেশ থেকেও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন।
অতীতে এদেশে প্রচুর এংলো ইন্ডিয়ানরা এদেশে বসবাস করতেন। নানা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও অবসরে তারা ক্লাব, হোটেল বা পার্টিতে গান বাজনা করতেন। আশির দশক পর্যন্ত বেশকিছু অসাধারন এংলো ইন্ডিয়ান মিউজিশিয়ান অনুসরনীয় হয়ে ছিলেন। মূলত এভাবেই এদেশে পাশ্চাত্যের সংগীতের প্রচার প্রসার ঘটতে থাকে, তৈরি হয় বিশাল ভক্তকুল। জনপ্রিয় বিদেশী শিল্পীদের রেকর্ড বাজারে সহজ প্রাপ্যতা পাশ্চাত্য সংগীতের শ্রোতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মীর শওকত আলী, মোসলেহ উদ্দিন, অশোক ঘোষ, রবিন ঘোষ, হুমায়ূন মিলে পুরাতন ঢাকাতে ১৯৫২ সালের দিকে এক গানের দল গড়ে তোলেন। অনেক চেষ্টা করেও এই গানের দলের নাম জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই দলটির সকল সদস্যই এখন প্রয়াত। ১৯৫৮/৫৯ সালের দিকে মিঃ পেরেরা, জন স্টোন টেলফোরডসহ কয়েকজন এংলো ইন্ডিয়ান এদেশের বিভিন্ন ক্লাব এবং হোটেলে গান করতেন। ৬০ সালের শুরু থেকেই “হোটেল শাহবাগ” (বর্তমান পিজি হাসপাতাল)এ নিয়মিত বিদেশী মিউজিসিয়ানদের শো শুরু হয়। ফিলিপিন্স থেকে কয়েকটি ব্যান্ড এদেশে অবস্থান করেও বিভিন্ন ক্লাব এবং হোটেলে নিয়মিত মিউজিক করে গিয়েছেন। এই ধরনের ব্যান্ডগুলিকে “হাউস ব্যান্ড” বলা হত।
১৯৬৩ সালে চট্রগ্রামে “জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী” নামক একটি গানের দলের যাত্রা শুরু হয়। কাদেরী কিবরিয়া, নাজমা জামান, শায়লা জামান, শাফাত আলী প্রমুখরা মিলেই এই শিল্পী গোষ্ঠী গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে জিংগা প্রথম ষ্টেজ শো করে। ফজলে, রফিক, সাব্বির, আলমগীর মিলে ১৯৬৪ সালে গঠন করেন “আইওলাইটস” নামে একটি ব্যান্ড। এটাকেই প্রথম পরিপূর্ণ ব্যান্ড বলা যেতে পারে। পরবর্তীতে এই ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” করা হয়, যারা ১৯৬৪ সালেই সর্বপ্রথম টিভিতে শো করার সুযোগ লাভ করে। ১৯৬৬ সালে এই ব্যান্ডের সদস্য আলমগীর পাকিস্তানে চলে গেলে বেস গিটারিস্ট হিসাবে ফাহমি ওমর এই ব্যান্ডে যোগদান করেন।
১৯৬৪/৬৫ সালে জাফর ইকবাল, ফারুক, তোতা, মাহমুদ, কাইয়ুম মিলে “র্যাম্বলিং স্টোন” ব্যান্ড গঠন করেন। ১৯৬৫ সালের শেষদিকে চট্রগ্রামে জন্ম নেয় নোয়েল, নিও মেন্ডিজ, শাকিল, ফরিদ রশিদদের নিয়ে “লাইটেনিংস”। বুচি, শাকিল, ফ্রান্সিস, রেগি পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে ব্যান্ডটির কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
১৯৬৭ সালে র্যাম্বলিং স্টোন, লাইটেনিংস, আইওলাইটস (উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার) এবং INSETS DUE এই ৪টি ব্যান্ডকে নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বলরুমে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” বিজয়ী হয়ে স্বনামধন্য EMI (HMV) কোম্পানি থেকে রেকর্ডস বের করার সুযোগ লাভ করে। যদিও এটা কোন গানের এ্যালবাম ছিলনা, ইন্সট্রুমেন্টাল এ্যালবাম ছিল। এই ১৯৬৭ সালে রবিনসহ আর কয়েকজন “টাইম এগো ইমোশন” ব্যান্ড গঠন করেন। এসবের পাশাপাশিও সেই সময়ে আরও কিছু ব্যান্ড গঠন হয়, কিন্তু নিয়মিত শো এর অভাবে তাদের অনেকগুলি ব্যান্ড আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি। সেই সময়কার বেশিরভাগ ব্যান্ডগুলি বাংলা গান করতেন না, মূলত ইংরেজি বা বিভিন্ন ভাষাভাষীর গান এবং ইন্সট্রুমেন্টাল করতেন।
১৯৬৯/৭০ সালে এনিটা, সীমা, জাহাংগীর, ইকবাল হায়দার, স্বপন, রতন, জ্যাকব, ইব্রাহিম মিলে চট্রগ্রামে গঠন করেন “স্পাইডার”, যারা পূর্বে “বেসুরা শিল্পগোষ্ঠী” নামে শুরু করেছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু, সোহেল, আহমেদ, দুলাল প্রমুখ পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও "বকলম" নামে সেসময়ে আর একটি ব্যান্ড তখন গঠন হয়।
১৯৭২ সালে রুমি, সাজ্জাদ, সালাউদ্দিন, দস্তগীর, শাহেদুল মিলে “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” ব্যান্ড গঠন করেন। যাদের একমাত্র এ্যালবাম ২০১৭ সালে রিলিজ হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই তারা হোটেল পূর্বাণীতে তাদের প্রথম শো করেন। এদিকে চট্রগ্রামে তখন এই ১৯৭২ সালেই জিলু খান, নকিব, আহমেদ হাসনাঈন, আঃ রশিদ, তসলিম, প্রবাল চৌধুরী, খসরু, পিলু মিলে “বালার্ক” ব্যান্ড গঠন করেন। পাশাপাশি সময়ে সাজেদ, রনি, লুলু, সাহেদ প্রমুখদের নেতৃত্বে “সুরেলা” গঠন হয়। ১৯৭৩ সালে “সুরেলা” নাম পরিবর্তন করে “সোলস” নামে যাত্রা শুরু করেন। তারপরে সোলস ব্যান্ডে তপন, আহমেদ নেওয়াজ, নকিব, তাজুল, ররেঞ্জ, রুডি যোগদান করেন। আরও পরে আইয়ুব বাচ্চু, নাসিম আলী এই ব্যান্ডে যোগ দেন। দ্যা মন্ডলস, রানা ৭৭, ব্লু হারমনি, রেইনবো, রিদম, জেনারেশন, নভেম্বর এলেভেন ব্যান্ডগুলিও সেই সময়ে চট্রগ্রামে পারফর্ম করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৭৩ সালে ঢাকাতে “উচ্চারণ” এবং “স্পন্দন” ব্যান্ডের জন্ম হয়। উচ্চারন ব্যান্ডের কন্ঠশিল্পী আজম খান ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে ঢাকা রেকর্ডস থেকে তার ৪ গানের একটি EP বের করেন। এটাকেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ্যালবাম বলা হয়। এ্যালবামটি সকলের কাছেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। উল্লেখ্য, আশিক মিউজিক এর আর্কাইভসে দুর্লভ এই এ্যালবামটি রয়েছে।
“আগলি ফেইজেস” নামে কামাল, সাকি মিলে এই সময়ে আর একটি ব্যান্ড গঠন করেন। আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস, আগলি ফেইজেস, উচ্চারণ, স্পন্দন ব্যান্ড একে একে তখন শো করতে থাকে। ১৯৭৩ সালে লাইটেনিংস ব্যান্ডের শো এর দিনে হোটেল পূর্বাণীতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। তারপরেই এই হোটেলে ব্যান্ডের শো বন্ধ হয়ে যায়।
অপরদিকে ১৯৭৪ সালে খুলনাতে টুলু, শেখ হেলাল, মনিরুজ্জামান মনি, খালিদ হাসান মিলু, খোকা, বুলবুল, মোস্তফা, জামাল, তরু, পান্না আজম, জুন, শওকতরা মিলে গড়ে তোলেন “স্পারটান” ব্যান্ড। ১৯৭৯/৮০ সালের দিকে খালিদ হাসান মিলু ব্যান্ড ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলে এবং অন্যান্য কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে ব্যান্ডটির লাইনআপে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে পান্নি খান প্রমুখরা তখন এই ব্যান্ডের হাল ধরেন।
১৯৭৫ সালে হ্যাপি, রুমি, রবিন, ইদু, কামাল, ইশতিয়াকরা “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” এর হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়মিত শো করতেন। কিছুদিন পরে বেস গিটারিস্ট সালাউদ্দিন ইংল্যান্ডে চলে গেলে “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝিতে রুমি, জয়, জাহিদ মিলে “এবনরমাল থ্রি প্লাস ওয়ান” গঠন করেন। এখানে রুমি কিছুদিন বাজিয়ে উইন্ডি সাইড অফ কেয়ারে যোগদান করলে “এবনরমাল থ্রি প্লাস ওয়ান” ব্যান্ডটিও ভেঙে যায়। এই সময়ে শামীমাসহ আরও কয়েকজন “ব্লুজ” নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন।
বগুড়াতে ১৯৭৬ সালে তৌফিকুল আলম টিপু গঠন করেন সাংস্কৃতিক দল “বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার”। তারাও নিয়মিত টিভিতে শো করতে থাকেন। ৭৬ সালের শেষদিকে “আল্ট্রাসনিক ব্যান্ড” এবং অন্যান্য কয়েকজন মিউজিসিয়ান পপসি, মুরাদ, কিংসলে রিক্টার, সেলিম হায়দার, স্যান্ড্রা হফ, জাকির, সানু রিক্টার, ফোয়াদ নাসের, হাফিজ মিলে গঠন করেন “ফিডব্যাক টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি”। পরবর্তীতে পিয়ারু খান, মাকসুদুল, রোমেল, খোকা এই ব্যান্ডে যোগ দেন এবং ব্যান্ডের নতুন নামকরণ করা হয় “ফিডব্যাক”।
পিলু, কুমার বিশ্বজিৎ, মিকি মান্নান, বিল্লু, সান্টু, বাবলু, নাসিম আলী খানরা মিলে ১৯৭৭-৭৮ সালে গঠন করেন আর একটি ব্যান্ড “নাট ক্রাকারস”।
হামিন, শাফিন, শাহিদুল, কমল, এবং নিনা মিলে ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন “ব্যারোক” ব্যান্ড গঠন করেন।
১৯৭৮ সালে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” ভেঙে গেলে ১৯৭৯ সালে ফরিদ রশিদ, কামাল, ল্যারি, ইশতিয়াক, মুসা, রবিন, হ্যাপিরা গঠন করেন “মাইলস”। ১৯৮২ সালে “মাইলস” তাদের প্রথম এ্যালবাম বের করে। এটি মূলত কিছু ইংরেজি গানের কভার এবং নতুন গান নিয়ে করা হয়েছিল। এ্যালবামটি “মধুমিতা” নামক প্রোডাকশন হাউজ থেকে বের হয়।
১৯৮০ সালে “সোলস” প্রথম টিভিতে শো করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। তারপর ১৯৮২ সালে “সোলস” তাদের প্রথম এ্যালবাম বের করেন। সেই এ্যালবামের “মন শুধু মন ছুঁয়েছে” গানটি এখনো কোটি হ্রদয়ের তৃষ্ণা মেটায়। এটাই বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড এ্যালবাম।
১৯৮২ সালে খুলনাতে “ব্রাইট স্টার” নামে একটি শিল্প গোষ্ঠী গঠন হয়। এই “ব্রাইট স্টার” থেকেই পরবর্তীতে ইভস, রিপল ট্র্যাক, রেসপন্স, ডিফারেন্ট টাচের জন্ম।
১৯৮১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কিছু জার্মান প্রবাসী ইফতেখার, মাহমুদ, মিঠু গঠন করেন “ওয়েভস” নামক মেটাল ব্যান্ড। পরে এদেশে আসার পর কামাল, শফিক, মিনু, নাটু, মিল্টন আকবর, মাকসুদ এই ব্যান্ডে বিভিন্ন সময়ে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে তারা প্রথম শো করে। ১৯৯৫ সালে তারা তাদের একমাত্র এ্যালবাম “পুরানো স্মৃতি” রিলিজ করেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম স্টুডিও লাইভ রেকর্ডিং ব্যান্ড এ্যালবাম, যা মাত্র ৪ ঘন্টায় অডিও আর্ট স্টুডিওতে রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়।
উইন্ডস (১৯৮২), চাইম (১৯৮৩), ফিলিংস (১৯৮৩), মেলোডি (১৯৮৩), ওয়ারফেজ (১৯৮৪), রক স্ট্রাটা (১৯৮৫), রেনেসাঁ (১৯৮৫), নোভা (১৯৮৫), সকিং ব্লু (১৯৮৬) ইত্যাদি ব্যান্ডগুলি একে একে গঠন হতে শুরু করে। সোলস, ফিডব্যাক, উইন্ডস, সকিং ব্লু, স্পাইডার, আর্ক, অবসকিওর, অডেসি, রেসপন্স, রেনেসাঁ, ড্রিমল্যান্ড ইত্যাদি প্রথমদিকের ব্যান্ডের এ্যালবামগুলির কারনেই ধীরে ধীরে এদেশের সাধারন শ্রোতারা ব্যান্ডের গানের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। জ্যাকব ডায়াসের হাত ধরে ১৯৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড “ব্লু বার্ডস” গঠন হয়।
তারপরে নোভা, প্রমিথিউস, উইনিং, সলিড ফিংগারস, শিঞ্জন, ম্যাসেজ, ওশেন, দ্যা ব্লুজ, ব্লু হরনেট, স্পার্ক, ডিফারেন্ট টাচ, ওয়ারফেজ, ইন ঢাকা, এলআরবি যুগের শুরু। আর শুরু হয়ে যায় তারুণ্যের উম্মাদনা “ব্যান্ড সংগীত”।
একে একে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী, অভেশন, রিভারভিউ, পানকৌড়ি, ব্লু বার্ডস, মিউজিক চ্যানেল, ইনসাইট, ইভস, পালস, কেইডেন্স, রেডরোজ, মিউজিক টাচ, অকটেভ, স্টার্লিং, এঞ্জেলস, স্পার্টান, মেলোডি, মেমোরি, নর্দার্ন স্টার, সাডেন, সান ডে, অরবিট, রিপল ট্র্যাক, সং ফেয়ার, লাকী লিপস, ডিজিটাল, বো মন্ড, মনিটর, নেক্সাস, ফ্লেমস, ফেবার, অটো রিভার্স, অর্কিড, গাঙচিল, তীর্থক, এ টু জেড, এঁদো, লেসন, পেপার রাইম, দ্যা কিউ, ব্লিডিং হার্টস, ব্লু ওয়েভ, দোজ হু কেয়ার, কনসার্ন, মাইক্রো, মাইক্রোবাস, ক্রস ফায়ার, ক্রস রোড, কিউপিড, মৌসখ, ওয়েসিস, দলছুট, বাংলাদেশ, কেওজ, ঢাকা রিদম সেকশন, কীর্তিনাশা, সুইট ভেনম, ডিসক, ড্রিমস, এভারগ্রীন, এভারলাস্ট, টাফ বয়েজ, ব্লু ওশান, ঈগলস, এলভিস, এনট্রেন, ফ্রম ওয়েস্ট, ফেয়ার টাচ, ট্রুপ, দ্যা ট্রুপস, ফেস্টিভ্যাল, গারল্যান্ড, সিম্ফনি, চার্মিং, গ্লাড টাইডার্স, গ্লোরিয়াস, হার্টবিট, ইকারাস, ফেইথ, মেম্বার্স ওনলি, মাকসুদ ও ঢাকা, মর্নিং স্টার, ইনসেনটিভ, লাইম লাইট, লিজেন্ড, মিউজিক হ্যাভেন, অনিক্স, ওপেন হার্ট, অরকিজ, অরফেয়ার্স, সেলেস্টিয়াল, অপশন, পীস, পেন্টাগন, দ্যা ট্রাপ, পার্সপেকটিভ, প্লেজার, পপিনজে, কিউএসবি, রেইন এন্ড রিভার, রেইনবো, রিফ্লেক্স, রেনেগেইডস, বার্নিং হার্ট, রকস বে, রুটস, রুট ফাইন্ডারস, স্বাধীনতা, স্যাডোজ, সিগনাল, স্প্লাশ, স্টেপস, স্ট্রাগল, স্কুয়ীকারস, স্টেনথ, সাসটেইন, সাসটেইন প্লাস, নিউ ইভস, টেক্সাস, ভিনাইল এন্ড সুগার, উইন্ডো, এইজেস, কিউডস, ডাউন টাউন, রক টাউন, রেন, এসএসভি, ফিল, মেভিস, জেন্টল বয়েজ, স্ট্রেঞ্জার্স, সাইক্লোন, প্যারাডাইজ, পাওয়ার টাচ, অসকিউলেট, এথেনা, টার্গেট টাচ, রংধনু, সারপ্রাইজ, ব্যাল্যান্স, ডিউ ড্রপস, র্যাম্বলারস, ত্রিসংগ, ইমোশন, রিলিজন, স্যান্ডারস, এইম, প্যানটম, ত্রিমূখী, সেভেন ইয়ংস, মেডুসা, সী বার্ডস, কোয়েস্ট, ব্যতিক্রম, আফটার ইমেজ, ইভা, রাশ অন, সেরেনেইড, অদ্বিতীয়, ফ্ল্যাশ, বাংলাদেশী বয়েজ, এঞ্জেল ফোর, পেনসিব বয়েজ, র্যাডিক্স, ইউনিফাই, মুখোশ, প্রতীক্ষা, লোনার, পীয়ারলেস, ছাইয়োনারা, কিংবদন্তি, ত্রিকাল, ভাটিয়াল, তান্ডব, ভাইকিংস, শিরোনামহীন, অর্থহীন, ব্লাক, স্টিলার, সফট টাচ, সাবকনসাস, মেটাল মেজ, সপ্তক, ফেস টু ফেস, আখড়া, বাংলা, বিদ্রোহী, ক্যালট্রপস, ক্যানোপি, ক্লে ফিংগারস, মেটামরফসিস, বেদুঈন, এড্রইট, এলিফ্যান্ট রোড, ইনোসেন্স, ইনসিগনিয়া, কাকতাড়ুয়া, কিউডস, ব্লাক আইজ, ব্লাক ডোরস, র্যাভেল, ক্রিপটিক ফেইট, স্টয়িক ব্লিজ, মুক্তি ৭১, মুসাফির, দূরবীন, আর্টসেল, পার্থিব, দ্যা ওয়াটসন ব্রাদার্স, পরবাসী প্রোজেক্ট, অবরোধ, নাইট মেয়ার, ইনডেক্স, মরফিয়াস, ভিন্সেন্ট ভ্যান গগ, অদৃশ্য, পিনড্রপ, ট্রুপার, ইকোস ইত্যাদি ব্যান্ড ক্যাসেট এ্যালবামের যুগে তাদের ক্যাসেট এ্যালবাম বের করে। এগুলির ভিতর থেকে এখনো কিছু ব্যান্ড তাদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।
২০০৯/১০ সালের দিকে ক্যাসেট যুগের বিলুপ্তি হলে আগেকার কিছু ব্যান্ডের সাথে অডিও সিডি এবং বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে ব্যান্ড লালন, চিরকুট, নেমেসিস, আর্বোভাইরাস, শূণ্য, মরুভূমি, পাওয়ার সার্জ, ব্লু জিনস, নোনতা বিস্কুট, ভাইব, মিনারভা, মেকানিক্স, নোঙর, নবযাত্রী, যাত্রী, ক্রসভেইন, ডি ইলুমিনেশন, করিডোর, আইকনস, প্রায় শূণ্য, বর্তমান, এসেজ, ডেডলক, ইন চিটাগাং, সার্কেল, অর্বাচীন, সাইলেন্ট টাইম, ব্লেজ, রেডিও একটিভ, শহরতলি, বিন্দু, ইনডালো, তীরন্দাজ, রিকল, স্টেনটোরিয়ান, আইওন, বে অফ বেঙ্গল, দৃক, কার্নিভ্যাল, রি-ধুন, অশ্রুত, অবলিক, ডট, অর্গান, রিবরণ, ওল্ড স্কুল, বোহেমিয়ান, মৃত্তিকা, ছায়াপথ, ল্যাম্পপোষ্ট, মেঘদল, নিয়ন, আবির্ভাব, ইন্দ্রজাল, মানচিত্র, আর্ট অফ নয়েজ, মহাকাল, জলের গান ইত্যাদি ছাড়াও অসংখ্য ব্যান্ড তাদের এ্যালবাম এ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে।
[পূর্বে বাংলাদেশের ব্যান্ডের অনেক তথ্যাদির সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি সংগৃহীত নাথাকার ফলে সময়ের ব্যবধানে তার অনেক কিছুই এখন হারিয়ে গিয়েছে। সেইসময়ের অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই, অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন, অনেকের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। তারপরেও গ্রহণযোগ্য প্রবীণ শিল্পীদের সাথে দফায় দফায় বসে উপরোক্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কিছু তথ্য হয়ত বাদ পড়তেই পারে, ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।]
অনুলিখনঃ ফোয়াদ নাসের বাবু ও গহর আশিক
[তথ্যসূত্রঃ ওমর খালিদ রুমী, নকিব খান, ফোয়াদ নাসের বাবু ]
ঢাকা ছাড়াও সমুদ্রবন্দর হওয়ায় চট্রগ্রামে বিভিন্ন সময়ে নানাদেশের মানুষ আসতেন। তারাও অবসরে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান বাজনা করতেন। এগুলি দেখেও তখনকার অনেক কিশোর যুবক এই সংগীতকে ভালবাসতে শুরু করেন। অনেকসময় এইসব বিদেশীরা এদেশ থেকে চলে যাবার সময় তাদের বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে যেতেন, সেগুলিই সর্বপ্রথম এদেশের মানুষের হাতে আসা শুরু করে। অবশ্য, অনেক ধনী পরিবারের সদস্য তখন বিদেশ থেকেও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন।
অতীতে এদেশে প্রচুর এংলো ইন্ডিয়ানরা এদেশে বসবাস করতেন। নানা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও অবসরে তারা ক্লাব, হোটেল বা পার্টিতে গান বাজনা করতেন। আশির দশক পর্যন্ত বেশকিছু অসাধারন এংলো ইন্ডিয়ান মিউজিশিয়ান অনুসরনীয় হয়ে ছিলেন। মূলত এভাবেই এদেশে পাশ্চাত্যের সংগীতের প্রচার প্রসার ঘটতে থাকে, তৈরি হয় বিশাল ভক্তকুল। জনপ্রিয় বিদেশী শিল্পীদের রেকর্ড বাজারে সহজ প্রাপ্যতা পাশ্চাত্য সংগীতের শ্রোতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
মীর শওকত আলী, মোসলেহ উদ্দিন, অশোক ঘোষ, রবিন ঘোষ, হুমায়ূন মিলে পুরাতন ঢাকাতে ১৯৫২ সালের দিকে এক গানের দল গড়ে তোলেন। অনেক চেষ্টা করেও এই গানের দলের নাম জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই দলটির সকল সদস্যই এখন প্রয়াত। ১৯৫৮/৫৯ সালের দিকে মিঃ পেরেরা, জন স্টোন টেলফোরডসহ কয়েকজন এংলো ইন্ডিয়ান এদেশের বিভিন্ন ক্লাব এবং হোটেলে গান করতেন। ৬০ সালের শুরু থেকেই “হোটেল শাহবাগ” (বর্তমান পিজি হাসপাতাল)এ নিয়মিত বিদেশী মিউজিসিয়ানদের শো শুরু হয়। ফিলিপিন্স থেকে কয়েকটি ব্যান্ড এদেশে অবস্থান করেও বিভিন্ন ক্লাব এবং হোটেলে নিয়মিত মিউজিক করে গিয়েছেন। এই ধরনের ব্যান্ডগুলিকে “হাউস ব্যান্ড” বলা হত।
১৯৬৩ সালে চট্রগ্রামে “জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী” নামক একটি গানের দলের যাত্রা শুরু হয়। কাদেরী কিবরিয়া, নাজমা জামান, শায়লা জামান, শাফাত আলী প্রমুখরা মিলেই এই শিল্পী গোষ্ঠী গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে জিংগা প্রথম ষ্টেজ শো করে। ফজলে, রফিক, সাব্বির, আলমগীর মিলে ১৯৬৪ সালে গঠন করেন “আইওলাইটস” নামে একটি ব্যান্ড। এটাকেই প্রথম পরিপূর্ণ ব্যান্ড বলা যেতে পারে। পরবর্তীতে এই ব্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” করা হয়, যারা ১৯৬৪ সালেই সর্বপ্রথম টিভিতে শো করার সুযোগ লাভ করে। ১৯৬৬ সালে এই ব্যান্ডের সদস্য আলমগীর পাকিস্তানে চলে গেলে বেস গিটারিস্ট হিসাবে ফাহমি ওমর এই ব্যান্ডে যোগদান করেন।
১৯৬৪/৬৫ সালে জাফর ইকবাল, ফারুক, তোতা, মাহমুদ, কাইয়ুম মিলে “র্যাম্বলিং স্টোন” ব্যান্ড গঠন করেন। ১৯৬৫ সালের শেষদিকে চট্রগ্রামে জন্ম নেয় নোয়েল, নিও মেন্ডিজ, শাকিল, ফরিদ রশিদদের নিয়ে “লাইটেনিংস”। বুচি, শাকিল, ফ্রান্সিস, রেগি পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে ব্যান্ডটির কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।
১৯৬৭ সালে র্যাম্বলিং স্টোন, লাইটেনিংস, আইওলাইটস (উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার) এবং INSETS DUE এই ৪টি ব্যান্ডকে নিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বলরুমে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” বিজয়ী হয়ে স্বনামধন্য EMI (HMV) কোম্পানি থেকে রেকর্ডস বের করার সুযোগ লাভ করে। যদিও এটা কোন গানের এ্যালবাম ছিলনা, ইন্সট্রুমেন্টাল এ্যালবাম ছিল। এই ১৯৬৭ সালে রবিনসহ আর কয়েকজন “টাইম এগো ইমোশন” ব্যান্ড গঠন করেন। এসবের পাশাপাশিও সেই সময়ে আরও কিছু ব্যান্ড গঠন হয়, কিন্তু নিয়মিত শো এর অভাবে তাদের অনেকগুলি ব্যান্ড আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি। সেই সময়কার বেশিরভাগ ব্যান্ডগুলি বাংলা গান করতেন না, মূলত ইংরেজি বা বিভিন্ন ভাষাভাষীর গান এবং ইন্সট্রুমেন্টাল করতেন।
১৯৬৯/৭০ সালে এনিটা, সীমা, জাহাংগীর, ইকবাল হায়দার, স্বপন, রতন, জ্যাকব, ইব্রাহিম মিলে চট্রগ্রামে গঠন করেন “স্পাইডার”, যারা পূর্বে “বেসুরা শিল্পগোষ্ঠী” নামে শুরু করেছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু, সোহেল, আহমেদ, দুলাল প্রমুখ পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও "বকলম" নামে সেসময়ে আর একটি ব্যান্ড তখন গঠন হয়।
১৯৭২ সালে রুমি, সাজ্জাদ, সালাউদ্দিন, দস্তগীর, শাহেদুল মিলে “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” ব্যান্ড গঠন করেন। যাদের একমাত্র এ্যালবাম ২০১৭ সালে রিলিজ হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই তারা হোটেল পূর্বাণীতে তাদের প্রথম শো করেন। এদিকে চট্রগ্রামে তখন এই ১৯৭২ সালেই জিলু খান, নকিব, আহমেদ হাসনাঈন, আঃ রশিদ, তসলিম, প্রবাল চৌধুরী, খসরু, পিলু মিলে “বালার্ক” ব্যান্ড গঠন করেন। পাশাপাশি সময়ে সাজেদ, রনি, লুলু, সাহেদ প্রমুখদের নেতৃত্বে “সুরেলা” গঠন হয়। ১৯৭৩ সালে “সুরেলা” নাম পরিবর্তন করে “সোলস” নামে যাত্রা শুরু করেন। তারপরে সোলস ব্যান্ডে তপন, আহমেদ নেওয়াজ, নকিব, তাজুল, ররেঞ্জ, রুডি যোগদান করেন। আরও পরে আইয়ুব বাচ্চু, নাসিম আলী এই ব্যান্ডে যোগ দেন। দ্যা মন্ডলস, রানা ৭৭, ব্লু হারমনি, রেইনবো, রিদম, জেনারেশন, নভেম্বর এলেভেন ব্যান্ডগুলিও সেই সময়ে চট্রগ্রামে পারফর্ম করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৭৩ সালে ঢাকাতে “উচ্চারণ” এবং “স্পন্দন” ব্যান্ডের জন্ম হয়। উচ্চারন ব্যান্ডের কন্ঠশিল্পী আজম খান ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে ঢাকা রেকর্ডস থেকে তার ৪ গানের একটি EP বের করেন। এটাকেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এ্যালবাম বলা হয়। এ্যালবামটি সকলের কাছেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। উল্লেখ্য, আশিক মিউজিক এর আর্কাইভসে দুর্লভ এই এ্যালবামটি রয়েছে।
“আগলি ফেইজেস” নামে কামাল, সাকি মিলে এই সময়ে আর একটি ব্যান্ড গঠন করেন। আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস, আগলি ফেইজেস, উচ্চারণ, স্পন্দন ব্যান্ড একে একে তখন শো করতে থাকে। ১৯৭৩ সালে লাইটেনিংস ব্যান্ডের শো এর দিনে হোটেল পূর্বাণীতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। তারপরেই এই হোটেলে ব্যান্ডের শো বন্ধ হয়ে যায়।
অপরদিকে ১৯৭৪ সালে খুলনাতে টুলু, শেখ হেলাল, মনিরুজ্জামান মনি, খালিদ হাসান মিলু, খোকা, বুলবুল, মোস্তফা, জামাল, তরু, পান্না আজম, জুন, শওকতরা মিলে গড়ে তোলেন “স্পারটান” ব্যান্ড। ১৯৭৯/৮০ সালের দিকে খালিদ হাসান মিলু ব্যান্ড ছেড়ে ঢাকায় চলে গেলে এবং অন্যান্য কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে ব্যান্ডটির লাইনআপে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে পান্নি খান প্রমুখরা তখন এই ব্যান্ডের হাল ধরেন।
১৯৭৫ সালে হ্যাপি, রুমি, রবিন, ইদু, কামাল, ইশতিয়াকরা “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” এর হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়মিত শো করতেন। কিছুদিন পরে বেস গিটারিস্ট সালাউদ্দিন ইংল্যান্ডে চলে গেলে “আন্ডারগ্রাউন্ড পিচ লাভারস” ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝিতে রুমি, জয়, জাহিদ মিলে “এবনরমাল থ্রি প্লাস ওয়ান” গঠন করেন। এখানে রুমি কিছুদিন বাজিয়ে উইন্ডি সাইড অফ কেয়ারে যোগদান করলে “এবনরমাল থ্রি প্লাস ওয়ান” ব্যান্ডটিও ভেঙে যায়। এই সময়ে শামীমাসহ আরও কয়েকজন “ব্লুজ” নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তোলেন।
বগুড়াতে ১৯৭৬ সালে তৌফিকুল আলম টিপু গঠন করেন সাংস্কৃতিক দল “বগুড়া ইয়ুথ কয়্যার”। তারাও নিয়মিত টিভিতে শো করতে থাকেন। ৭৬ সালের শেষদিকে “আল্ট্রাসনিক ব্যান্ড” এবং অন্যান্য কয়েকজন মিউজিসিয়ান পপসি, মুরাদ, কিংসলে রিক্টার, সেলিম হায়দার, স্যান্ড্রা হফ, জাকির, সানু রিক্টার, ফোয়াদ নাসের, হাফিজ মিলে গঠন করেন “ফিডব্যাক টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি”। পরবর্তীতে পিয়ারু খান, মাকসুদুল, রোমেল, খোকা এই ব্যান্ডে যোগ দেন এবং ব্যান্ডের নতুন নামকরণ করা হয় “ফিডব্যাক”।
পিলু, কুমার বিশ্বজিৎ, মিকি মান্নান, বিল্লু, সান্টু, বাবলু, নাসিম আলী খানরা মিলে ১৯৭৭-৭৮ সালে গঠন করেন আর একটি ব্যান্ড “নাট ক্রাকারস”।
হামিন, শাফিন, শাহিদুল, কমল, এবং নিনা মিলে ১৯৭৮ সালে গড়ে তোলেন “ব্যারোক” ব্যান্ড গঠন করেন।
১৯৭৮ সালে “উইন্ডি সাইড অফ কেয়ার” ভেঙে গেলে ১৯৭৯ সালে ফরিদ রশিদ, কামাল, ল্যারি, ইশতিয়াক, মুসা, রবিন, হ্যাপিরা গঠন করেন “মাইলস”। ১৯৮২ সালে “মাইলস” তাদের প্রথম এ্যালবাম বের করে। এটি মূলত কিছু ইংরেজি গানের কভার এবং নতুন গান নিয়ে করা হয়েছিল। এ্যালবামটি “মধুমিতা” নামক প্রোডাকশন হাউজ থেকে বের হয়।
১৯৮০ সালে “সোলস” প্রথম টিভিতে শো করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। তারপর ১৯৮২ সালে “সোলস” তাদের প্রথম এ্যালবাম বের করেন। সেই এ্যালবামের “মন শুধু মন ছুঁয়েছে” গানটি এখনো কোটি হ্রদয়ের তৃষ্ণা মেটায়। এটাই বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড এ্যালবাম।
১৯৮২ সালে খুলনাতে “ব্রাইট স্টার” নামে একটি শিল্প গোষ্ঠী গঠন হয়। এই “ব্রাইট স্টার” থেকেই পরবর্তীতে ইভস, রিপল ট্র্যাক, রেসপন্স, ডিফারেন্ট টাচের জন্ম।
১৯৮১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কিছু জার্মান প্রবাসী ইফতেখার, মাহমুদ, মিঠু গঠন করেন “ওয়েভস” নামক মেটাল ব্যান্ড। পরে এদেশে আসার পর কামাল, শফিক, মিনু, নাটু, মিল্টন আকবর, মাকসুদ এই ব্যান্ডে বিভিন্ন সময়ে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে শিল্পকলা একাডেমীতে তারা প্রথম শো করে। ১৯৯৫ সালে তারা তাদের একমাত্র এ্যালবাম “পুরানো স্মৃতি” রিলিজ করেন। এটি বাংলাদেশের প্রথম স্টুডিও লাইভ রেকর্ডিং ব্যান্ড এ্যালবাম, যা মাত্র ৪ ঘন্টায় অডিও আর্ট স্টুডিওতে রেকর্ডিং সম্পন্ন হয়।
উইন্ডস (১৯৮২), চাইম (১৯৮৩), ফিলিংস (১৯৮৩), মেলোডি (১৯৮৩), ওয়ারফেজ (১৯৮৪), রক স্ট্রাটা (১৯৮৫), রেনেসাঁ (১৯৮৫), নোভা (১৯৮৫), সকিং ব্লু (১৯৮৬) ইত্যাদি ব্যান্ডগুলি একে একে গঠন হতে শুরু করে। সোলস, ফিডব্যাক, উইন্ডস, সকিং ব্লু, স্পাইডার, আর্ক, অবসকিওর, অডেসি, রেসপন্স, রেনেসাঁ, ড্রিমল্যান্ড ইত্যাদি প্রথমদিকের ব্যান্ডের এ্যালবামগুলির কারনেই ধীরে ধীরে এদেশের সাধারন শ্রোতারা ব্যান্ডের গানের সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। জ্যাকব ডায়াসের হাত ধরে ১৯৯০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যান্ড “ব্লু বার্ডস” গঠন হয়।
তারপরে নোভা, প্রমিথিউস, উইনিং, সলিড ফিংগারস, শিঞ্জন, ম্যাসেজ, ওশেন, দ্যা ব্লুজ, ব্লু হরনেট, স্পার্ক, ডিফারেন্ট টাচ, ওয়ারফেজ, ইন ঢাকা, এলআরবি যুগের শুরু। আর শুরু হয়ে যায় তারুণ্যের উম্মাদনা “ব্যান্ড সংগীত”।
একে একে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী, অভেশন, রিভারভিউ, পানকৌড়ি, ব্লু বার্ডস, মিউজিক চ্যানেল, ইনসাইট, ইভস, পালস, কেইডেন্স, রেডরোজ, মিউজিক টাচ, অকটেভ, স্টার্লিং, এঞ্জেলস, স্পার্টান, মেলোডি, মেমোরি, নর্দার্ন স্টার, সাডেন, সান ডে, অরবিট, রিপল ট্র্যাক, সং ফেয়ার, লাকী লিপস, ডিজিটাল, বো মন্ড, মনিটর, নেক্সাস, ফ্লেমস, ফেবার, অটো রিভার্স, অর্কিড, গাঙচিল, তীর্থক, এ টু জেড, এঁদো, লেসন, পেপার রাইম, দ্যা কিউ, ব্লিডিং হার্টস, ব্লু ওয়েভ, দোজ হু কেয়ার, কনসার্ন, মাইক্রো, মাইক্রোবাস, ক্রস ফায়ার, ক্রস রোড, কিউপিড, মৌসখ, ওয়েসিস, দলছুট, বাংলাদেশ, কেওজ, ঢাকা রিদম সেকশন, কীর্তিনাশা, সুইট ভেনম, ডিসক, ড্রিমস, এভারগ্রীন, এভারলাস্ট, টাফ বয়েজ, ব্লু ওশান, ঈগলস, এলভিস, এনট্রেন, ফ্রম ওয়েস্ট, ফেয়ার টাচ, ট্রুপ, দ্যা ট্রুপস, ফেস্টিভ্যাল, গারল্যান্ড, সিম্ফনি, চার্মিং, গ্লাড টাইডার্স, গ্লোরিয়াস, হার্টবিট, ইকারাস, ফেইথ, মেম্বার্স ওনলি, মাকসুদ ও ঢাকা, মর্নিং স্টার, ইনসেনটিভ, লাইম লাইট, লিজেন্ড, মিউজিক হ্যাভেন, অনিক্স, ওপেন হার্ট, অরকিজ, অরফেয়ার্স, সেলেস্টিয়াল, অপশন, পীস, পেন্টাগন, দ্যা ট্রাপ, পার্সপেকটিভ, প্লেজার, পপিনজে, কিউএসবি, রেইন এন্ড রিভার, রেইনবো, রিফ্লেক্স, রেনেগেইডস, বার্নিং হার্ট, রকস বে, রুটস, রুট ফাইন্ডারস, স্বাধীনতা, স্যাডোজ, সিগনাল, স্প্লাশ, স্টেপস, স্ট্রাগল, স্কুয়ীকারস, স্টেনথ, সাসটেইন, সাসটেইন প্লাস, নিউ ইভস, টেক্সাস, ভিনাইল এন্ড সুগার, উইন্ডো, এইজেস, কিউডস, ডাউন টাউন, রক টাউন, রেন, এসএসভি, ফিল, মেভিস, জেন্টল বয়েজ, স্ট্রেঞ্জার্স, সাইক্লোন, প্যারাডাইজ, পাওয়ার টাচ, অসকিউলেট, এথেনা, টার্গেট টাচ, রংধনু, সারপ্রাইজ, ব্যাল্যান্স, ডিউ ড্রপস, র্যাম্বলারস, ত্রিসংগ, ইমোশন, রিলিজন, স্যান্ডারস, এইম, প্যানটম, ত্রিমূখী, সেভেন ইয়ংস, মেডুসা, সী বার্ডস, কোয়েস্ট, ব্যতিক্রম, আফটার ইমেজ, ইভা, রাশ অন, সেরেনেইড, অদ্বিতীয়, ফ্ল্যাশ, বাংলাদেশী বয়েজ, এঞ্জেল ফোর, পেনসিব বয়েজ, র্যাডিক্স, ইউনিফাই, মুখোশ, প্রতীক্ষা, লোনার, পীয়ারলেস, ছাইয়োনারা, কিংবদন্তি, ত্রিকাল, ভাটিয়াল, তান্ডব, ভাইকিংস, শিরোনামহীন, অর্থহীন, ব্লাক, স্টিলার, সফট টাচ, সাবকনসাস, মেটাল মেজ, সপ্তক, ফেস টু ফেস, আখড়া, বাংলা, বিদ্রোহী, ক্যালট্রপস, ক্যানোপি, ক্লে ফিংগারস, মেটামরফসিস, বেদুঈন, এড্রইট, এলিফ্যান্ট রোড, ইনোসেন্স, ইনসিগনিয়া, কাকতাড়ুয়া, কিউডস, ব্লাক আইজ, ব্লাক ডোরস, র্যাভেল, ক্রিপটিক ফেইট, স্টয়িক ব্লিজ, মুক্তি ৭১, মুসাফির, দূরবীন, আর্টসেল, পার্থিব, দ্যা ওয়াটসন ব্রাদার্স, পরবাসী প্রোজেক্ট, অবরোধ, নাইট মেয়ার, ইনডেক্স, মরফিয়াস, ভিন্সেন্ট ভ্যান গগ, অদৃশ্য, পিনড্রপ, ট্রুপার, ইকোস ইত্যাদি ব্যান্ড ক্যাসেট এ্যালবামের যুগে তাদের ক্যাসেট এ্যালবাম বের করে। এগুলির ভিতর থেকে এখনো কিছু ব্যান্ড তাদের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে।
২০০৯/১০ সালের দিকে ক্যাসেট যুগের বিলুপ্তি হলে আগেকার কিছু ব্যান্ডের সাথে অডিও সিডি এবং বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফরমে ব্যান্ড লালন, চিরকুট, নেমেসিস, আর্বোভাইরাস, শূণ্য, মরুভূমি, পাওয়ার সার্জ, ব্লু জিনস, নোনতা বিস্কুট, ভাইব, মিনারভা, মেকানিক্স, নোঙর, নবযাত্রী, যাত্রী, ক্রসভেইন, ডি ইলুমিনেশন, করিডোর, আইকনস, প্রায় শূণ্য, বর্তমান, এসেজ, ডেডলক, ইন চিটাগাং, সার্কেল, অর্বাচীন, সাইলেন্ট টাইম, ব্লেজ, রেডিও একটিভ, শহরতলি, বিন্দু, ইনডালো, তীরন্দাজ, রিকল, স্টেনটোরিয়ান, আইওন, বে অফ বেঙ্গল, দৃক, কার্নিভ্যাল, রি-ধুন, অশ্রুত, অবলিক, ডট, অর্গান, রিবরণ, ওল্ড স্কুল, বোহেমিয়ান, মৃত্তিকা, ছায়াপথ, ল্যাম্পপোষ্ট, মেঘদল, নিয়ন, আবির্ভাব, ইন্দ্রজাল, মানচিত্র, আর্ট অফ নয়েজ, মহাকাল, জলের গান ইত্যাদি ছাড়াও অসংখ্য ব্যান্ড তাদের এ্যালবাম এ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছে।
[পূর্বে বাংলাদেশের ব্যান্ডের অনেক তথ্যাদির সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি সংগৃহীত নাথাকার ফলে সময়ের ব্যবধানে তার অনেক কিছুই এখন হারিয়ে গিয়েছে। সেইসময়ের অনেকেই এখন আমাদের মাঝে নেই, অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন, অনেকের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে পারিনি। তারপরেও গ্রহণযোগ্য প্রবীণ শিল্পীদের সাথে দফায় দফায় বসে উপরোক্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কিছু তথ্য হয়ত বাদ পড়তেই পারে, ভুলত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করছি।]
অনুলিখনঃ ফোয়াদ নাসের বাবু ও গহর আশিক
[তথ্যসূত্রঃ ওমর খালিদ রুমী, নকিব খান, ফোয়াদ নাসের বাবু ]
Comments
Post a Comment